আজ মুম্বইতে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে সর্বসমতিক্রমে এক রাজনৈতিক প্রস্তাব অনুমোদন পেল। তাতে বলা হল, আমরা ইন্ডিয়া গোষ্ঠীভুক্ত পার্টিরা আগামী লোকসভা নির্বাচন যতদূর পারা যাবে একসঙ্গে লড়ব। আসন সমঝোতা ইত্যাদি নিয়ে দেওয়া ও নেওয়ার ভিত্তিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা ইন্ডিয়া গ্রুপের সদস্যরা একসঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জনসভা আয়োজন করে মানুষকে মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলো নিয়ে প্রচারে নামব। আমরা ইন্ডিয়া গোষ্ঠীর সদস্যরা জুড়েগা ভারত জিতেগা ইন্ডিয়া এই মূল বিষয়কে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে আমাদের পরিকল্পনা এবং প্রচারকে তুলে ধরব। হ্যাঁ, এই সর্বসম্মতিতে অনুমোদিত প্রস্তাব সংবাদমাধ্যমে এসেছে, আমাদের দফতরেও এসেছে। এবং যখন এইসব কথা বলা হচ্ছে তখন দেশের অন্য দুই প্রান্তে ঠিক বিপরীত এক ছবি আমরা দেখছি। উত্তরবঙ্গের ধূপগুড়িতে কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী আর সিপিএম-এর কমরেড সেলিম তৃণমূল ও বিজেপিকে বাংলা থেকে হঠানোর জন্য যৌথসভায় ভাষণ দিচ্ছেন। কমরেড সেলিম বলছেন দিদি-মোদি এক হ্যায়, অধীর চৌধুরী বলছেন বাংলায় আমাদের তৃণমূল আর বিজেপি দুজনকেই হারাতেই হবে। অন্যদিকে কেরালার পুথুপাল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী কমরেড পিনারাই বিজয়ন কেরলের স্বার্থ বিরোধী কংগ্রেসের জামানত জব্দ করার আহ্বান করছেন। ওখানেই অন্য মঞ্চ থেকে কংগ্রেস নেতা পি জে জোসেফ সিপিআইএম-কে স্বৈরতান্ত্রিক, খুনি তকমা দিয়ে ওই পুথুপাল্লিতে হারানোর আবেদন করছেন। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, সেলিম-অধীরের কেরালায় কুস্তি, বাংলায় দোস্তির গল্প।
গতকালই বলেছিলাম বাংলার এই ফল্ট লাইনের কথা। বলেছিলাম হাইকমান্ডের নির্দেশ এলে র্যানটাক বা ইনো খেয়ে অধীরবাবু চুপ করে যাবেন, কিন্তু কমরেড সেলিমের পক্ষে থামাটা সম্ভব নয়। বাংলার গোটা দল চলছে তীব্র মমতা বিরোধিতার জ্বালানি নিয়ে, দলের উচ্চতম থেকে এক্কেবারে তলার সারিতে মমতা বিরোধিতাই প্রথম এবং শেষ কথা। আবার এমনও তো নয় যে এই বিরোধিতার সামনে দাঁড়িয়ে তৃণমূল দল বৈষ্ণব সাধুর মতো আচরণ করছে, সেখানেও বহু আগে থেকেই তীব্র সিপিএম বিরোধিতা জমা হয়েই রয়েছে, কিন্তু তৃণমূলকে এ বাংলায় মূলত শুভেন্দু, সুকান্ত, দিলীপ ঘোষদের বিরুদ্ধেই লড়তে হচ্ছে তাই তৃণমূলের তলার সারির কর্মীদের সিপিএম বিরোধিতার চেয়েও আপাতত জোর শুভেন্দু বিরোধিতায়, বিজেপি বিরোধিতায়। একই রকমভাবে কেরলে সিপিএম-এর পাঁচ পুরুষের লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গেই, বিজেপির সঙ্গে সিপিএম-এর জমিতে লড়াই কোথায়? দুটো আসনের ত্রিপুরা ছাড়া আর কোথায়? বাকি ৫৪০টা আসনের মধ্যে বাংলা আর কেরলে সিপিএম-এর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় কংগ্রেসের সঙ্গে নয় তৃণমূলের সঙ্গে।
আরও পড়ুন: Aajke | হ্যাঁ, এ বাংলায় আসন-রফা হচ্ছে কংগ্রেস-তৃণমূলের
এদিকে থিওরিটিক্যালি, খাতায় কলমে ওঁরা ফ্যাসিবাদ বিরোধী, ওঁরা আরএসএস–বিজেপি বিরোধী, জমিতে যাদের বিজেপির বিরুদ্ধে এতটুকু লড়াইও নেই, কিন্তু তাঁরা তাঁদের কপিবুক স্টাইল মেনটেন করার জন্যই ফ্যাসিবাদ বিরোধী জোটে আছেন, না থেকে যাবেনই বা কোনদিকে? এবং দলের কর্মীদের বোঝাবেন কী? দেশের রাজনীতিতে বিজেপি বিরোধী দলগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মুম্বই বৈঠক থেকে ফিরে বাংলার কর্মীদের কাছে কী বলবেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি? বলবেন কি যে ঐ বৈঠকে একসঙ্গে মোদির বিরুদ্ধে প্রচার করার জন্য প্রচার কমিটিতে আমরাও আছি, তৃণমূলও আছে? কেরলে গিয়ে বলতে পারবেন যে রাস্তায় শুধু নয় সামাজিক মাধ্যমেও আমরা কংগ্রেসের সঙ্গে মিলেই বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার করব? না পারবেন না। এরপরে লোগো বের হবে, সেই লোগো, থিমকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দেবেন ইন্ডিয়া জোটের প্রতিনিধিরা, তার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা হবে, জায়গা নির্বাচন হবে, বলতে পারবেন দলের সদস্যদের যে সেই পরিকল্পনার জন্য সর্বোচ্চ কমিটিতে তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও আছে? সম্ভবত বলতে পারবেন না বা বলতে লজ্জা করবে বলেই ওই সর্বোচ্চ কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের নাম দিতে নারাজ সিপিএম। মানে আবার কৌশল, জোটে থাকব কিন্তু জোটে থাকব না গোছের ব্যাপার। আমরা প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের দর্শকদের কাছে, ইন্ডিয়া জোটের সর্বোচ্চ কমিটিতে আছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, এদিকে সেই জোটের অন্যতম সদস্য কমরেড সেলিম ইডি দফতর ঘেরাও করবেন সেই অভিষেকের গ্রেফতারের দাবিতে, এটা কোন ধরনের রাজনীতি? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
বামপন্থাই রুখে দাঁড়াতে পারত এই ফ্যাসিবাদী আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে, বামপন্থীরাই নেতৃত্ব দিতে পারত এই লড়াইয়ের, বামপন্থাই তো মানুষের মূল লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। আমাদের দেশের বামপন্থীরা দেশের সবচেয়ে কঠিনতম পরিস্থিতিতে উল্টো পথে চলে এসেছে আজ নয় শুরু থেকেই, সেই ৪২-এর ভারত ছাড়ো থেকেই। সেই সময় বামপন্থীরা এই আন্দোলনে থাকলেন না, দেশ স্বাধীন হল, কমিউনিস্টরা বললেন ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। এরপরে ৭৭-এর জয়প্রকাশের আন্দোলন, সিপিআইএম সেখানেও নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব রাখার কথা বলেই সঙ্গে গেল না। জুলাই ক্রাইসিস থেকে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্ব ভুলের পাহাড় নিয়ে আবার এক ভুলের দিকে পা দিচ্ছে দেশের সবথেকে বড় বামপন্থী দল, বা বলা যাক এ ছাড়া তাদের কাছে অন্য কোনও বিকল্প পথও খোলা নেই। ধূপগুড়িতে দোস্তি আর পুথুপাল্লিতে কুস্তির রাজনীতি মানুষ নিশ্চয়ই বুঝবে, তার ফলাফল ও আমরা দেখতে পাব।